মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০২:৫৪ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বে-সরকারি ভাবে নির্বাচিত কসবায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ আহত-৪ কসবায় এলজিইডি’র শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আগরতলায় স্রোত আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসব কসবা প্রেসক্লাব সভাপতি’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সভা কসবায় চকচন্দ্রপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ফলাফল ঘোষণা, পুরস্কার বিতরণ ও ছবক প্রদান শ্রী অরবিন্দ কলেজের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান আজ বছরের দীর্ঘতম রাত, আকাশে থাকবে চাঁদ বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করেছে-কসবায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৩ দিনের জন্য ভোটের মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী
খোশবাগ সিরাজের সমাধি প্রেম এবং বিশ্বাসঘাতকতা নিরব সাক্ষী

খোশবাগ সিরাজের সমাধি প্রেম এবং বিশ্বাসঘাতকতা নিরব সাক্ষী

লোকমান হোসেন পলা।।

সমগ্র ভারত বর্ষের ইতিহাস পরিবর্তনের জন্য কালের সাক্ষী হয়ে যে স্থানটি সু অথবা কু পরিচিত তার নাম মুর্শিদাবাদ। বিশ্বাসঘাতকতা আর রক্তাক্ত অতীতের এক নগরী এই মুর্শিদাবাদের খোশবাগ। এক বিশাল উপমাহাদেশ খন্ড বিখন্ড হবার শুরুটা হয়েছিল এখান থেকে । তাই বোধয় মুসলিম প্রধান এই অঞ্চলটিকে সবাই এড়িয়ে চলতে চায় । এড়িয়ে চলতে চায় নিষ্ঠুর ইতিহাসকে ।

খোশবাগ এই বিশাল কবরখানা যেন এক মহাভারত সম বিশাল উপন্যাসের মতো। দুই ধর্মের ধনী ও দরিদ্রের প্রেম, অন্তহীন ভালোবাসা, অপার স্নেহ এবং বল্গাহীন নৃশংসতা, দু:সহ জীবন, অনি:শেষ যন্ত্রণা, শত্রু ও মিত্রের রং বদল, জীবন ও মৃত্যুর মিশে যাওয়া এক রঙীন বাগিচা। বাংলায় এমন জায়গা কোথায় আছে আর?

মুর্শিদাবাদ থেকে ভাগিরথি নদী পাড় হতেই চারদিকে সবুজ এবং সবুজ। কত রকম গাছ।কবরের হেড মালি সেলিম তাঁর হিন্দু মুসলিম সহকারীদের নিয়ে নতুন করে বাগান সাজানোর বিষয়ে আলোচনা করছেন ।যদিও পদে ওরা মালি কিন্তু মূল গাইড়ের মতো সার্ভিস ও দিয়ে থাকে। এই বাগানে ১০৮ রকম গোলাপ ফুটত একদা। নিহত নবাবের বিধবা স্ত্রী এক কোণে কুঁড়েঘরে থাকতেন। প্রতিদিন ওই বাগানের পরিচর্যা করতেন। প্রতিদিন মালা দিতে, প্রদীপ জ্বালাতে যেতেন স্বামী, দেওর, শ্বশুরের কবরে। একটা সময় স্বামীর হত্যাকারী তাঁর শিশুকন্যাকে নদীতে চুবিয়ে অবিশ্বাস্য ভাবে মারে এবং মহিলা পাগল হয়ে যান। তবু আঁকড়ে রেখেছিলেন স্বামীর শেষ শয্যা।

মিরজাফর ও মিরন, বাবা-ছেলে দু’জনেই লুৎফুন্নেসা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বিয়ে করে প্রাসাদের হারেমে রাখার। তিনি রাজিই হননি। বলেছিলেন, ‘হাতির পিঠে যে চড়েছে, সে গাধার পিঠে চড়বে না।’ তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাজধানী মুর্শিদাবাদের ও পারে ভাগীরথি ধারে এই কবরখানায় একাকিনী পরিচারিকা হয়ে থাকার প্রস্তাব। ইংরেজরাই তাঁকে মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। সিরাজের এই বেগমের নাম ছিল লুৎফুন্নেসা। লুৎফ মানে ভালোবাসা, নেসা মানে স্ত্রী। পুরো মানে প্রিয়তমা স্ত্রী। ক্রীতদাসী হিসেবে তিনি এসেছিলেন আলিবর্দি খানের পরিবারে। হিন্দু মেয়ে। নাম ছিল রাজকানওয়ার। সিরাজদৌল্লার মা আমিনা বেগমের বাঁদী লুৎফার রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করেন সিরাজ।এটি ছিল নবাবের দ্বিতীয় বিয়ে, সিরাজের প্রথম বিবাহ হয় ১৭৪৬ সালের আগস্ট মাসে ইরাজ খান নামে একজন অভিজাত ব্যক্তির কন্যা উমদাতুন্নেসার (বহু বেগম) সাথে। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে সিরাজের কোনো সন্তান ছিল না।

সত্তর দশকে বাংলায় এক বিখ্যাত সিনেমা হয়েছিল, ‘আমি সিরাজের বেগম’। সিরাজ বিশ্বজিৎ, লুৎফা সন্ধ্যা রায়। এ নামে একটা বইও ছিল। শ্রীপারাবতের লেখা। খোশবাগের এককোণে এখনও লুৎফার কুঁড়ে ঘরের চিহ্ন দেখা যায়। একটু উঁচু জায়গা। দেবদারু ও বতুল গাছের ছায়ায়। গাইডরা বলেন, ওখানেই থাকতেন লুৎফা। দেখে সন্ধ্যা রায়ের মিষ্টি মুখ খানা মনে পড়ে যায়। সিরাজের তবু দু’তিনটি ছবি দেখা যায়। লুৎফার তো একটাও নেই। তাই হয়তো লুৎফা বললে আগে তরুণী সন্ধ্যা রায়ের মুখ ভাসে। লুৎফুন্নেসার প্রেম। অবহেলিত খোশবাগ যেন সেই প্রেমের খুশবু ছড়ায়। ভিন সম্প্রদায়ের, ভিন জগতের, ধনী ও দরিদ্রের প্রেমের সুগন্ধ। তখন মনে হয় না, এক বিশাল কবরখানায় দাঁড়িয়ে আছি। যা গা শিউরে ওঠা গণহত্যার প্রতীক। ৩৪ টি কবর রয়েছে এই ৭.৬৫ একর জমির ওপর। তার মধ্যে লুৎফা বাদে সবাই মারা যান এক দেড় বছরের মধ্যেই। নবাব পরিবারের নানা রকম চরিত্র এখানে শেষ শয্যায় শুয়ে। শত্রু এবং মিত্র পাশাপাশি। নবাব ও তাঁকে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া বিশ্বাসঘাতক সামান্য দূরে শুয়ে। আমিনা ও ঘষেটি, দুই বেগম, সিরাজের মা ও মাসি, দু’জনে পাশাপাশি শুয়ে। ঘষেটি বেগম দেওয়ান হোসেনকুলি খাঁর প্রেমিকা। মুর্শিদাবাদের লোকের মুখে মুখে ঘুরছিল গোপন প্রেমের কথা। নবাব আলিবর্দি খান ও তাঁর স্ত্রী বেগম সরফুন্নেসা প্রচণ্ড রেগে যান মেয়ের কীর্তিকলাপে। দাদু ও দিদিমার কথায় সিরাজই তাঁর লোকদের দিয়ে খুন করান হোসেনকুলি ও তাঁর অন্ধ ভাইকে। মুর্শিদাবাদে প্রকাশ্য রাস্তায়। মুর্শিদাবাদের গাইডরা বলেন, সিরাজের ছিন্নভিন্ন দেহ যখন হাতির পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হচ্ছে শহরে, তখন হোসেনকুলিকে যেখানে খুন করা হয়, সেখানেই কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়েছিল সিরাজের মৃতদেহ থেকে। আর সিরাজকে যখন মিরনের লোক মহম্মদী বেগ মিথ্যা কথা বলে খুন করছেন, তখন সিরাজ নাকি বলেছিলেন, ‘হোসেনকুলির অন্যায় হত্যার ফলে আমার এই পরিণাম।(কথিত কথা)

খোশবাগেই ঢুকতেই দেখা যায়, সেই মা এবং দুই মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে। মাসি ঘসেটি ছিলেন সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়িক এখানে শুয়ে । তাঁরাই পাশাপাশি চিরকালের মতো শুয়ে। তৃতীয় বোনের স্বামী পূর্ণিয়ার নবাব ছিলেন বলে তাঁর কবর পূর্ণিয়াতে। অথচ তাঁর ছেলের কবর আবার এখানে। তিন বেগমের কবর পেরিয়ে, সিরাজের কবরখানার দিকে গেলে, বাঁ দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। রাজমহল পাহাড়ে যে লোকটা সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিল, সেই দানশা ফকিরের কবর এখানে রাখা হল কেন? কে রাখল? ইংরেজরা না, মিরজাফর পুত্র মিরন?
খোশবাগের গাইডরা আশপাশের গ্রামের ছেলে। কথায় কথায় বলেন, ‘মিরজাফরের চেয়েও হারামি ছিল ওর ছেলে মিরন।’ খোশবাগের শান্ত সবুজ কবরখানা ঘুরে বেড়ালে মনে হয়, ওঁরা ভুল বলেন না। ফকিরকে সপরিবার মেরেছিল মিরনই। হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিতে ডেকে এনেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, ‘যে সোনার লোভে বাংলার নবাবকে ধরিয়ে দিতে পারে, সে তো আমাদেরও ধরিয়ে দিতে পারে। তোমাদের শাস্তি মৃত্যু।’ মেরেই ফেলেন তাদের। ডান দিকে চোখ রাখলে ১৭ টি গণকবর। সিরাজের আত্মীয়দের ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদের এনেছিলেন মিরন। সিরাজের সঙ্গে শেষ দেখা করাবেন বলে। সেখানেই খাবারে বিষ মিশিয়ে মারেন এঁদের।
বলছিলাম না, খোশবাগের কবরখানায় এত ভিন্নধর্মী চরিত্রের কবর যে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। সিরাজকে ধরিয়ে দেওয়ার লোকটির পরিবারের কবর পেরিয়ে মূল করবস্থান। নাম বারদুয়ারি। বারোটা দরজার প্রাসাদ। ঢুকলেই বাঁ দিকে তিনটি কবর। মাঝের জন গোলাম হোসেন। পাশের দু’জন আব্দুল হোসেন ও শাব্দুল হোসেন। এই দু’জন ছিলেন খোজা–লুৎফার দেহরক্ষী। আর গোলাম হোসেন ছিলেন সিরাজের সবচেয়ে অনুগত রক্ষী। গাইডরা বলেন, গোলাম হোসেনই ভগবানগোলায় সিরাজ এবং লুৎফাকে তুলে দিয়েছিলেন নৌকায়। পালানোর জন্য। বলেছিলেন, ‘আমার আর কোনও উপায় নেই নবাব!’ সেই থেকে তাঁর নাম ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন’। ইনি ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। পদবি চক্রবর্তী। যাত্রা করতেন খুব। সিরাজের প্রধান দেহরক্ষী ।
খোশবাগের প্রধান কবরস্থান বারোদুয়ারিতেও অনেক বিস্ময়। গোটা বাগানের একমাত্র লম্বা পাম গাছটি এর গায়ে। মূল কবর থেকে দূরের প্রধান গেট দেখা যায়। বিশাল ঘরে সবচেয়ে বড় কবরটি আলিবর্দি খানের। তাঁর পাশে সিরাজের কবরটি ছোটই। ব্যতিক্রম বলতে, পাশে একটি লম্বা শ্বেতপাথরের ফলক।
গাইডের গলা এখানে এসেই কেমন আবেগমথিত হয়ে যায়। গলা কাঁপিয়ে বলে, ‘এটাই বাংলা, বিহার, ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার কবর।’
সিরাজের কবরের পাশে তাঁর পালিত ভাই মির্জা মেহদি। মিরন তাকে ১৪ বছর বয়সে হাতির পায়ের তলায় পিষে মারে। সিরাজের পায়ের নীচে লুৎফা এবং আলিবর্দির পায়ের তলায় সিরাজের মেয়ের কবর। যে মেয়েকে নদীতে চুবিয়ে মারেন মিরন এবং লুৎফা পাগল হয়ে যান।সিরাজের এই মেয়ের নাম ছিল জোহরা। অন্য তথ্যকে জানা যায় জোহরাকে মীর আসাদ আলী খানের সাথে বিয়ে দেয় হয় এবং জোহরার এক পুত্র ও চার কন্যা জন্মদেয়।
বারোদুয়ারির ঘরের তৃতীয় কবরটি কার? একেবারে লুৎফার কবরের পাশের কবরটি আলিয়া বাঈজি । আসল নাম মাধবী। সিরাজ সেনাপতি মোহনলালের বোন। বাঈজি সিরাজকে নানা খবর এনে দিতেন। এক রকম গুপ্তচর।
লুৎফা প্রায় ১৭ বছর পরিচর্যা করে গিয়েছেন, এখানে।
বারোদুয়ারি ঘরে শেষ দুটি কবরেও বিস্ময়। সিরাজের মাসতুতো ভাই সওকত জং ও তাঁর স্ত্রী। পূর্ণিয়ার নবাব সওকত চেয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব হতে। সিরাজের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি হেরে যান। আবার পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের হয়ে নামেন। আবার প্রশ্ন জাগে, ঠিক এভাবেই যে সবাইকে কবর দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিল কে? প্রথম দিকে না হয় মিরজাফর-মিরন। পরের দিকে কারা? ইংরেজরা?
কত মোচড়, কত নাটক, কত সম্পর্কের ভাঙা গড়া এই খোশবাগের কবরখানা। তার মধ্যেই চোখে লেগে থাকে সিরাজের সবচেয়ে অনুগত একদা হিন্দু ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন’ এর কবর থেকে সোজা দক্ষিণে তাকিয়ে একটু উঁচু ভিটে। ওই খানেই থাকতেন সিরাজ ঘরণী লুৎফা ওরফে রাজকানওয়ার। মালা গাঁথতেন, প্রদীপ জ্বালাতেন। ঘন সবুজ বন, গোলাপ বাগানের মাঝ দিয়ে হেঁটে আসতেন স্বামীর কবরে, মেয়ের কবরে।

তথ্য সূত্র : ১. ইতিহাসের অন্তরালে : ফারুক মাহমুদ, ২. সিরাজউদ্দৌলা : অক্ষয় কুমার মৈত্র, ৩. মুর্শিদাবাদ কাহিনী : নিখিল নাথ রায়, ৪, আলীবর্দী এন্ড হিজ টাইমস : কে কে দত্ত, ৫. বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস : আব্দুর রহীম, ৬. নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও বাংলার মসনদ : ড. মুহাম্মদ ফজলুল হক, ৭. চেপে রাখা ইতিহাস : আল্লামা গোলাম আহমাদ মোর্তজা।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD